ফিতনা সম্পর্কে একজন মুমিনের করণীয়

মাওলানা যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

ইসলামী শরীয়তের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা যে, মানুষকে মারুফ অবলম্বন করতে হবে এবং মুনকার ত্যাগ করতে হবে। কুরআনে কারিমের বহু জায়গায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মারুফকে অবলম্বন করার এবং মুনকারকে বর্জন করার, মারুফের প্রতি আদেশ করার এবং মুনকার থেকে মানুষকে বিরত রাখার আদেশ করেছেন। এজন্য ইসলামী শরীয়তে যেমন ন্যায় এবং সত্যকে জানা ও মানার গুরুত্ব রয়েছে, এরকম অন্যায়-অসত্য, বিভ্রান্তি-বিচ্যুতি এসকল বিষয় সম্পর্কে জেনে যত্নের সাথে বেঁচে থাকার এবং মানুষকে বাঁচাবার চেষ্টা করারও গুরুত্ব রয়েছে। এটা ইসলামী শরীয়তের অনেক বড় একটি শিক্ষা যে, ভালো এবং সত্য বিষয়কে অবলম্বন করতে হবে, মন্দ এবং অন্যায় বিষয়কে বর্জন করতে হবে। চিন্তাগতভাবে, বিশ্বাসগতভাবে, কর্মগতভাবে, সবক্ষেত্রেই ভালো এবং সত্যকে অবলম্বন করতে হবে, মন্দ এবং মিথ্যাকে বর্জন করতে হবে।

ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এটি যে, ইসলামী দাওয়াতের অঙ্গনে যারা কাজ করবেন ইসলামের দায়ীগণ, তারা যেমন ইসলামের শিক্ষা এবং আদর্শকে মানুষের নিকটে পৌঁছে দিবেন, এটা যেমন তাদের দায়িত্ব, ঠিক তেমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের পরিপন্থী যা কিছু রয়েছে, যেগুলো মানুষকে আদর্শিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে, মানুষের ঈমান-আমলকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, মানুষের দুনিয়া এবং আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, ওই সকল বিষয় সম্পর্কেও তাদেরকে সচেতন করা এবং ঐসকল বিষয় থেকে তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা, এটিও ইসলামী দাওয়াতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গন।

এবিষয়টি ইসলামের শিক্ষা এবং দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ার কারণেই মূলত আজ পর্যন্ত চৌদ্দশ বছর পরেও ইসলাম অবিকৃত অবস্থায় টিকে আছে। মুনকারকে নিষেধ করার এবং মুনকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে এসকল বিষয় থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা এবং এই চেষ্টার গুরুত্বের বিধান যদি ইসলামে না থাকতো, তাহলে পূর্বের অন্য অনেক ধর্মের মত ইসলাম বিকৃত হয়ে যেত এবং বিলুপ্ত হয়ে যেত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই উম্মতের উপর যেমন ইসলামের শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার, সর্বস্তরের মানুষের নিকটে ইসলামের শিক্ষাকে পৌঁছে দেওয়ার আদেশ এবং দায়িত্ব আরোপ করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা পরিপন্থী, আকীদা-বিশ্বাস পরিপন্থী, কর্ম-আমল পরিপন্থী যা কিছু রয়েছে, এই সকল বিষয় সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে ঐ সকল বিষয় থেকে মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্বও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই উম্মতের উপর আরোপ করেছেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এজন্য আমাদের অনেক তত্ত্বজ্ঞানী এবং দূরদর্শী মনীষীগণের বক্তব্য হলো, ইসলামী দাওয়াতের যেমন বিস্তৃতি প্রয়োজন এরকম গভীরতা প্রয়োজন। ইসলামের দুটো বিষয়, এক হলো তাবলীগে ইসলাম, ইসলামের প্রচার-প্রসার, আরেক হলো হিফযে ইসলাম, ইসলামি শিক্ষার সংরক্ষণ, ইসলামী শিক্ষাকে সব রকমের বিকৃতি থেকে, সব রকমের অপব্যাখ্যা থেকে রক্ষা করা। এটাও ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক হলো, ইশাআতে ইসলাম, ইসলামের শিক্ষাগুলো মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়া, আরেক হলো হিফাযতে ইসলাম, ইসলামকে রক্ষা করা, ইসলামের যে শিক্ষা, ইসলামের যে আদর্শ, সেই শিক্ষা এবং আদর্শকে অবিকৃত অবস্থায় মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়া। সবরকমের বিকৃতি-বিভ্রান্তি থেকে ইসলামের শিক্ষাকে রক্ষা করা।

আপনারা যদি ইসলামের দাওয়াতের ইতিহাস এবং আমাদের মনীষীদের ইতিহাস পড়েন তাহলে সেখানে দেখবেন যে, আমাদের প্রত্যেক শ্রেণীর মনীষীগণ যেমন তার সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামের শিক্ষাগুলোকে প্রচার করেছেন, প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন ঠিক তেমনিভাবে ওই অঙ্গনে যত রকমের বিচ্যুতি এবং বিকৃতি এসেছে সেগুলো চিহ্নিত করেছেন। আমাদের আইম্মায়ে হাদীস যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু সালামের হাদিস শরীফ সংরক্ষণ করেছেন তারা যেরকম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত এবং বাস্তব সত্য বাণীগুলোকে সংরক্ষণ করেছেন ঠিক তেমনিভাবে যে সকল বিষয় আল্লাহর রাসূলের বাণী ও কর্ম নয়, কিন্তু ভুলক্রমে বা কারো চক্রান্তের ফল হিসেবে এগুলোকে আল্লাহ রাসূলের বাণী হিসেবে, কর্ম হিসেবে প্রচার করা হয়েছে সেগুলোকে তারা চিহ্নিত করে দিয়েছেন। একথাটি ইলমুল হাদীসের পরিভাষায় এভাবে বলা যায়, যে রকম আমাদের আইম্মায়ে হাদিস সহীহ হাদীসের সংকলন প্রস্তুত করেছেন ঠিক তেমনিভাবে যেগুলো হাদিস নয় যেগুলো মাওযূ এবং প্রক্ষিপ্ত বর্ণনা, সেসকল মাওযূ এবং প্রক্ষিপ্ত বর্ণনারও সংকলন প্রস্তুত করেছেন। কেন প্রস্তুত করেছেন? এজন্য প্রস্তুত করেছেন যেন এগুলো আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস হিসেবে স্বীকৃতি পেতে না পারে। এরকম সব অঙ্গনে আপনি দেখবেন, যারা সুন্নত এর অঙ্গনে কাজ করেছেন, ঐসকল মনীষী যেরকম জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ মানুষকে শিখিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে মানুষের জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে যে সকল বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ওই সকল বিদআতকে বিদআত হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন, যে এগুলো দীনের অংশ নয়, এগুলো অনুসরণীয় বিষয় নয়, এগুলো সুন্নত নয়। কেউ যদি এগুলোকে সুন্নত মনে করে, দীনের অংশ মনে করে আমল করতে থাকে তাহলে সেটা সওয়াবের কাজ হবে না, বরং সেটা গুনাহের কাজ হবে, এটা বিদআত।

যেভাবে তারা সুন্নতকে সংরক্ষণ করেছেন এবং সুন্নতের প্রচার-প্রসার করেছেন ঠিক তেমনিভাবে তারা বিদ’আতকে চিহ্নিত করেছেন এবং বিদআত সম্পর্কে সাবধান করেছেন। তো এরকম সবক্ষেত্রে, যেরকম তাওহীদের কথা বলেছেন, তাওহীদের শিক্ষা দিয়েছেন, তেমনিভাবে তাওহীদের বিপরীত কথা-কাজ, বিশ্বাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে যা কিছু শিরক রয়েছে, সেগুলোকে তারা চিহ্নিত করেছেন এবং মানুষকে শিরক থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। এভাবে কিন্তু ইসলামের শিক্ষাও অবিকৃত থেকেছে এবং মুসলমান প্রকৃত ইসলামের উপর, সঠিক ইসলামের উপর চলা তাদের পক্ষে সহজ হয়েছে। চৌদ্দশ’ বছর পরেও ইসলাম আমাদের নিকটে শুধু সংরক্ষিত থাকে নি, বরং অবিকৃত অবস্থায় ইসলাম সংরক্ষিত থেকেছে। এবং চৌদ্দশ বছর পরও মুসলমানদের বিরাট এক জামাত এমন রয়েছে যারা সঠিক ইসলামের উপর, আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর পক্ষ থেকে যে আদর্শ এসেছে, তিনি যে আদর্শ নিয়ে এসেছেন সে আদের্শের উপরে তারা চলতে পারছে। অন্তত ইচ্ছা করলে চলার সুযোগ তাদের জন্য রয়েছে।
এজন্য এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যেভাবে ইসলামের শিক্ষাগুলো আমাদের জানতে হবে মানতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের চারপাশে ইসলামের শিক্ষা-পরিপন্থী যে সকল বিষয় রয়েছে, যে সকল ফিতনা-বিভ্রান্তি রয়েছে এবং আমাদের চারপাশে থাকার কারণে যেগুলোর শিকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, ওই সকল ফিতনা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা থেকে নিজের ঈমান-আমল রক্ষা করার চেষ্টা করা এটাও মুসলমানের কর্তব্য।

(হাদীস শাস্ত্র পরিচিতি-২ কোর্সের দ্বিতীয় দারস প্রদান করেন শায়খ মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ হাফিযাহুল্লাহ। শায়খের দারসের শিরোনাম ছিল, হাদীস অস্বীকারের ফেতনা: ভয়াবহতা ও কারণ। দারসের শুরুতে ফিতনা সম্বন্ধে জানার ও বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শায়খ অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা পেশ করেন। গুরুত্ব বিবেচনায় আলোচনাটি পত্রস্থ করে এখানে উপস্থাপন করা হলো)

 

Facebook

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

হজ গাইডলাইন বিতরণ

কিতাব বিতরণ প্রজেক্ট এর অংশ হিসেবে ৪-৫ মে ২০২৪ হিজরীতে অনুষ্ঠিত হজ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী ৬০ জন হাজিকে হজ গাইডলাইন

Read More »