আল্লাহ তা‘আলা হযরত মাওলানা রহ.কে যে বিচিত্র গুণাবলীতে ভূষিত করেছিলেন তা আমাদের সময়ের মানুষের মধ্যে একসাথে খুব কম পাওয়া যায়। দেখতে-শুনতে যেমন সুদর্শন, সুবেশী ছিলেন, তেমনি ছিলেন সুরসিক, সদালাপী। ইলমী যোগ্যতার পাশাপাশি নিজ উস্তাদ ও মুরব্বিদের জন্য বলা যায় ফেদা ছিলেন। বহু দেশ সফর করেছেন, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাত ও সাহচর্য পেয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেইসব সাক্ষাত ও অভিজ্ঞতার কথা বলতেও পারতেন। তার জীবন সত্যিকার অর্থেই একটি বিচিত্র কর্মময় জীবন ছিল, যার দাস্তান সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তা অনেক বড় পাথেয় হতে পারে।
যদ্দুর মনে পড়ে হযরত মাওলানাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম হাটহাজারী মাদরাসার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে। তখন আমি সেখানে শরহে বেকায়া বা হেদায়া পড়ি। ঐ সময়ের স্মৃতি এখনও মানসপটে উজ্জ্বল। একজন অভিজাত, রাশভারী, উজ্জ্বল, সুদর্শন আলিমকে আমি সেদিন দেখেছিলাম। ঐদিনের মাহফিল-মঞ্চে হযরত মাওলানা মুফতি নুরুল্লাহ সাহেবও ছিলেন। তার সাথে সম্ভবত তার নামের জিহাদী শব্দটি নিয়ে একটু খুনসুটিও হয়েছিল।
তাকে নিয়ে এই আমার প্রথম স্মৃতি। এরপর আর কোনো পরিচয় বা যোগাযোগ ছিল না।
পরে যখন জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ মাদরাসায় পড়ি তখন কখনো কখনো শুনতাম আমাদের পার্শ্ববর্তী মহল্লায় তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের একজন কর্মধার আলিম থাকেন। কিন্তু পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি।
দাওরায়ে হাদিসের পর হঠাৎ করে আমার মরহুম আব্বাজান তাঁর সম্পর্কে বললেন। এবং একপর্যায়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হলো। এটা ২০০১ সালের কথা। আজ ২০ বছর পর যখন তার সম্পর্কে দু‘কলম লিখতে বসেছি তখন তার স্নেহ ও শফকতের কথাই বড় করে মনে পড়ছে।
পরিবারের সদস্যদের জন্য তিনি ছিলেন একজন স্নেহশীল অভিভাবক। তাদেরকে শাসন যেমন করতেন সোহাগও করতেন। ছুটি-ছাটায় ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিদের নিয়ে তার যে আসর জমত সেটা ছিল দেখার মতো। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গল্প করতেন, হাসতেন, হাসাতেন। নিজে নাশিদ গেয়ে শোনাতেন। সব কিছুর মধ্যে একটি সহজতা, শালীনতা ও হৃদ্যতা বজায় থাকত।
মহল্লার সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তার উপস্থিতি ছিল অভিভাবক-সুলভ। ছেলে-বুড়ো তরুণ-যুবক সব বয়সের সব শ্রেণীর মানুষ তার কাছে আসত, সুখ-দুঃখের কথা বলত। সাধ্যমত তিনি সবার পাশে থাকতেন। নিজ মহল্লায় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মহল্লার অনেক মানুষ তাঁর সাহচর্যে উলামা ভক্ত হয়েছেন।
নিজেও ইলম-দোস্ত মানুষ ছিলেন। মেধাবী ব্যক্তিদের প্রতি তার একটা সহজাত আকর্ষণ ছিল। কিতাব-পত্র পছন্দ করতেন। তার নিজের ঘরেও মূল্যবান কিতাব পত্রের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন।
তার উস্তাযগণের ইলমী কামালাতের কথা খুব ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে আলোচনা করতেন। উস্তাযগণের আলোচনা শুরু হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যেত।
এই অধম নিজেও অনেক গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর মুখে আকাবিরীনের গল্প শুনেছি। তাঁর সেইসব গল্প শুনে আমি তাঁর কাছে দরখাস্ত করেছিলাম, আপনি আপনার এই অভিজ্ঞতাগুলো লিখে ফেললে খুব সুন্দর হতো।
হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. শাইখুল হাদীস হযরত যাকারিয়া রহ. হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম প্রমুখ ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তাঁকেও তার জীবন-কাহিনী লেখার অনুরোধ করেছিলাম।
আলহামদু লিল্লাহ, এরপর তিনি লেখালেখির পিছনে বেশ সময় দিয়েছেন এবং বেশ কিছু মূল্যবান বই নিজ উদ্যোগে প্রকাশও করেছেন। কিন্তু এই সব বইয়ে তাঁর কর্ম ও অভিজ্ঞতার খুব সামান্য অংশই এসেছে।
বিভিন্ন বিষয়ে ছোটদের সাথেও মুযাকারা মশোয়ারা করতেন। তাদের মতামতকে মূল্যায়ন করতেন। সবক্ষেত্রে ধীর-স্থির বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যেত।
জীবনের শেষের দিকে একটি কঠিন পরিস্থিতিতে যখন তিনি হেফাযতে ইসলামের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বিভিন্ন পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন।
যে কোনো পর্যায়ের মানুষের সাথে কথা বলতে পারতেন। যে কোনো মজলিসকে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলতে পারতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে কারাবন্দী উলামায়ে কেরামের মুক্তির ব্যাপারে অত্যন্ত ব্যস্ত ও তৎপর সময় কাটিয়েছেন। শুধু তাঁর এই দিনগুলোও যদি রোযনামচা আকারে সংরক্ষণ করা যেত তাহলেও তা আমাদের এই সময়ের অনেক মূল্যবান একটি দলীল হয়ে থাকত।
রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ে ও দেশ-বিদেশের বহু আধুনিক বিত্তশালী মানুষের সাথে বিচরণের পরও তাঁর ঘরে পরিবারে পর্দা পুশিদা ও স্বাভাবিক দীনদারীর একটি স্নিগ্ধ পরিবেশ সবসময়ই বিরাজমান ছিল। আমার কাছে তাঁর এই বৈশিষ্ট্য খুবই মূল্যবান মনে হয়েছে। প্রচুর মেহমানদারী করতেন, দরাজহাতে খরচও করতেন, কিন্তু অপচয়-অপব্যয় ও অপ্রয়োজনীয় আড়ম্বরের স্বভাব তাঁর মধ্যে ছিল না।
আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল নেক আমলকে কবুল করুন। তার ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিন। তাঁর কবরকে শীতল রাখুন। তাকে তাঁর নেক বান্দাদের মধ্যে স্থান দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।