কুরবানী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবানদের উপর কুরবানী ওয়াজিব। এটি ইসলামের মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত এবং প্রতীকি বিধানাবলির অন্যতম।
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সম্পর্কে পশ্চিমা ধ্যানধারণা দ্বারা প্রভাবিত একশ্রেণির মানুষ সাম্প্রতিক সময়ে নিতান্ত গর্হিত মন্তব্য করে চলেছে। ‘কুরবানী না করে কুরবানীর টাকা গরীব-দু:খীকে দান করাই শ্রেয়’ এমন সব উদ্ভট কথা বলছে এবং এর স্বপক্ষে স্থুল কিছু যুক্তিও তুলে ধরছে।
মুমিনদের কাছে তাদের এসব কথা অবুঝ শিশুর প্রলাপ বৈ কিছু নয়। কিন্তু তারপরও এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে হচ্ছে।
১. যারা ইসলামের মৌলিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, বিশেষ করে ইসলামের ইবাদত ও কুরবানী-র তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না, সাধারণত তারাই এধরনের মন্তব্য করে থাকে।
বস্তুত ইবাদতের তাৎপর্য হচ্ছে, যেহেতু বান্দা আল্লাহ তাআলার গোলাম, তাঁর-ই সৃষ্টি এবং তিনিই তার স্রষ্টা ও মালিক, অতএব বান্দাকে আপন রবের নির্দেশ বিনা যুক্তিতে, মনে-প্রাণে ও আস্থার সাথে গ্রহণ করতে হবে এবং কার্যে পরিণত করতে হবে। বলাবাহুল্য, ইসলামের অন্যতম মৌলিক ইবাদত কুরবানীর মাঝে এ তাৎপর্যটি অত্যন্ত প্রোজ্জ্বল। আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নিজ সন্তান কুরবানীর জন্য উদ্যত হওয়ার ঘটনাটি এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সারকথা, কুরবানী হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার বিধানের নি:শর্ত আনুগত্য স্বরূপ একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাঁর নির্দেশমত পশু জবাই করা।
এই যখন কুরবানীর তাৎপর্য, সুতরাং আল্লাহর বান্দা ও গোলাম হয়ে একথার কী অর্থ যে, কুরবানী করা লাগবে না, কিংবা কুরবানীর চেয়ে দান করাই শ্রেয়!! এসব উদ্ভট কথা আপন মালিক ও রবের বিধান ও নিদের্শ প্রাপ্তির পর পরোক্ষভাবে তাঁর আদেশকে অবমাননা ও অমান্য করার নামান্তর নয় কি?
২. কুরবানীর মূল শিক্ষা ‘আল্লাহ তায়ালার আদেশের নি:শর্ত আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ’ এতটাই শক্তিশালী যে, এ শিক্ষা ও চেতনা লালনকারী ব্যক্তি ও সমাজ পঙ্কিলতা মুক্ত এক আদর্শ ও অপ্রতিরোধ্য সমাজে পরিণত হয়। কেননা এ চেতনায় উজ্জীবিত মানুষ কখনো নিজ প্রবৃত্তির তাড়নায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে অপরাপর মানুষের ক্ষতি করতে পারে না, পারে না পার্থিব লোভ-লিপ্সার শিকার হয়ে অন্যের ধন-সম্পদ, ইজ্জত-আব্রু নষ্ট করতে। এমনিভাবে আদর্শ এ সমাজে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের যে দৃষ্টান্ত তৈরি হয়, তার নজির অন্য কোথাও মেলা সম্ভব নয়।
সুতরাং, বুদ্ধিমান ব্যক্তির করণীয় কি এটাই নয় যে, সে এ শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে কুরবানীর প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে?
৩. এমনও কিছু মানুষের কথা শুনা যায়, যারা কুরবানীকে অপচয় বলতেও দ্বিধা করে না, (নাউযুবিল্লাহ!!)। আসলে তারা ‘অপচয়’ বলে কি বুঝাতে চায়, তারা নিজেরাও তা বুঝে কিনা সন্দেহ। কারণ-
অপচয় বলা হয়, মূল্যবান সম্পদকে এমনভাবে ব্যয় করা কিংবা ব্যবহার করা, বাস্তবিক অর্থে যাতে দীন-দুনিয়ার উল্লেখযোগ্য কোনো উপকার নেই।
অপচয়ের সংজ্ঞা বোঝার পর ন্যূনতম ইনসাফের অধিকারী ব্যক্তি কুরবানীর ন্যায় মহান ইবাদতকে ‘অপচয়’ বলার দু:সাহস দেখাতে পারে না। মহান রবের দেওয়া সম্পদ তাঁরই হুকুম পালনে ব্যয় করা কি করে অপচয় হতে পারে?? উপরন্তু এমন ব্যয়, যে ব্যয়ে জাগতিক বহু কল্যাণ রয়েছে, যে ব্যয়ে আর্ত-মানবতার খেদমত ও সেবা রয়েছে।
৪. যারা কুরবানী নিয়ে আপত্তি করে, তারা কি জানে না, ইসলামে অসহায়-দু:স্থ মানুষকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার স্বতন্ত্র ও মজবুত বিধান রয়েছে। যাকাত ইসলামের রুকন ও গুরুত্বপূর্ণ চার বিধানের একটি হওয়ার বিষয়টি কি তারা জীবনেও শোনে নি? তারা কি দেখেনি, বিভিন্ন দুর্যোগে ইসলামী শরীয়তের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুমিনগণ সাধারণ অনুদানের মাধ্যমে কত ব্যাপক ও স্বত:স্ফূর্তভাবে মানবতার কল্যাণে ঝাপিয়ে পড়েন?
অতএব, এরপরও কুরবানীর বিধানে আপত্তি করার কোনো বৈধতা থাকতে পারে কি?