রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মুসলিম মনীষীগণ একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র ও সাইন্স তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য ছিল, হাদীসের প্রামাণ্যতা যাচাই পূর্বক নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহকে অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে পৃথক করা এবং হাদীসের মহামূল্যবান ভান্ডার সংরক্ষণ করা। নবী যুগে এ শাস্ত্রের সূচনা হয় এবং পরবর্তীতে এর উপর ব্যাপক কাজ হয়।
এ শাস্ত্রের একটি পারিভাষিক নাম হল ‘নাকদুল হাদীস’। অর্থাৎ হাদীসের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করা এবং প্রতিটি বক্তব্যের বিষয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যে, তা রাসূলের হাদীস কিনা।
ইতিহাসের প্রামাণ্যতা বিচারের লক্ষ্যে প্রাচ্যবিদরাও একটি ম্যাথড ব্যবহার করে থাকে। তাদের ম্যাথডটির নাম ‘হিস্টরিকল কৃটিকাল ম্যাথড’ Historical Critical Method, সংক্ষেপে বলা হয় H.C.M.। হিস্টরিকল কৃটিকাল ম্যাথড হলো, ইতিহাস যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন সম্বলিত একটি ম্যাথড। ওরিয়েন্টালিস্টরা এই ম্যাথড দিয়ে রাসূলের হাদীস ফিল্টারিং করার চেষ্টা করেছেন। পক্ষান্তরে মুসলিম মনীষীগণও নিজস্ব শাস্ত্রের মাধ্যমে হাদীস যাচাই-বাছাই করেছেন।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মুসলিম মনীষীদের হাদীস বিচার পদ্ধতি (নাকদুল হাদীস) ও প্রাচ্যবিদদের হিস্টরিকাল কৃটিসিজম, উভয়টির মাঝে কোনটি বেশি নির্ভরযোগ্য। বিশেষত মুসলিম মনীষীদের ‘নাকদুল হাদীস’ কি এমন যে, তা প্রাচ্যবিদদের পদ্ধতি থেকে দুর্বল এবং এর মাধ্যমে হাদীস যাচাইয়ের বিষয়টি যথেষ্ট নয়, অতএব মুসলিমদের উচিত, এক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদদের ম্যাথড অনুসরণ করা।
এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু কথা তুলে ধরছি।
প্রথম কথা হলো, যেসকল প্রাচ্যবিদের মাঝে ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠতা ছিল, স্বয়ং তারাই একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মুসলিম মনীষীদের ‘নাকদুল হাদীস’ তথা হাদীস যাচাইয়ের পদ্ধতিটি যথার্থ ও অত্যন্ত সুদৃঢ়। এর মাধ্যমে মুসলিমগণ শুরু থেকেই অত্যন্ত সুনিপুণভাবে হাদীস যাচাই করেছেন এবং আজও পর্যন্ত হাদীসকে সংরক্ষিত করে রেখেছেন। ‘নাকদুল হাদীসের’ মাধ্যমে বহু আগেই মুসলিমরা হাদীস থেকে প্রক্ষিপ্ত (জাল) বর্ণনা ফিল্টারিংয়ের (পৃথকীকরণের) কাজটি সেরে ফেলেছেন। প্রাচ্যবিদদের এ সংক্রান্ত কিছু বক্তব্য সামনে উপস্থাপন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় যে বিষয়টি বুঝতে হবে তা হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর হাদীসের ক্ষেত্রে সাহাবীদের ভূমিকা কি ছিল। সাহাবীরা কি কোনো বাছ-বিচার ছাড়া যে কোনো বক্তব্যকে রাসূলের হাদীসরূপে গ্রহণ করে ফেলতেন, নাকি নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের আলোকে ও সুনির্দিষ্ট সিস্টেমের আওতায় তারা হাদীস গ্রহণ-বর্জনের কাজটি করতেন।
নির্ভরযোগ্য ইতিহাস থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহাবীগণ শুরু থেকেই সুনির্দিষ্ট ম্যাথড ব্যবহার করেছেন এবং তাদের ম্যাথড ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক।
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রহ তাযকিরাতুল হুফফায (১/৯) গ্রন্থে বলেছেন,
كان أول من احتاط في قبول الأخبار
হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে সর্বপ্রথম যিনি সতর্কতা অবলম্বন করেছেন এবং মানুষকে সতর্ক করেছেন তিনি হলেন প্রথম খলিফা।
তাঁর ইন্তিকালের পর দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক রাযি. এর কর্মপন্থা সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রহ. (১/১১) বলেন,
هو الذي سن للمحدثين التثبت في النقل
রেওয়ায়েত গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন ও সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন অনুসরণের পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন হযরত উমর ফারুক রাযি.।
এভাবে প্রত্যেক যুগে কারা কারা হাদীসের নাকিদ বা কৃটিক (critic) ছিলেন এবং তারা কি পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, এর সুস্পষ্ট রেকর্ড মুসলিমদের নিকট সংরক্ষিত আছে।
রাসূলের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত হাদীসের কি অবস্থা, কারা কারা হাদীস কৃটিসাইজ (যাচাই-বাছাই) করেছেন, কিভাবে করেছেন, এ সংক্রান্ত যাবতীয় ইতিহাস মুসলিমদের নিকট এমনভাবে রেকর্ড আছে যে, এর মাঝে কোনো গ্যাপ নেই। এক্ষেত্রে এমনটি হয়নি যে, প্রথমে রেকর্ড করা হয়নি, পরে এসে গ্যাপগুলো জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে।
সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী যুগের মনীষীগণ কিভাবে হাদীস যাচাই করেছেন, এ বিষয়টি অনেক বিস্তৃত এবং অনেক দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে, এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে যার সুযোগ নেই। তবে সহজ-সরলভাবে এমন দু-একটি বিষয় তুলে ধরছি, যেটা সকলের জন্য বোঝা সহজ হবে।
বর্তমানে পুরো বিশ্বে অনেক রিপোর্টার আছেন। তারা যখন সংবাদ শুনেন তখন সংবাদটি গ্রহণযোগ্য কিনা তা কিভাবে যাস্টিফাই করেন? এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে যে সিস্টেম চালু আছে সেটাকে একজন গবেষক এভাবে ব্যক্ত করেছেন, Tree Tiered system (তিন ধাপের পদ্ধতি)। এ তিনটি ধাপ হলো,
1. Demanding a source
2. Investing its reliability
3. Seeking out corroborating evidence
রিপোর্টারদের নিকট যে কোনো সংবাদ যাচাইয়ের প্রথম ধাপ হলো, ‘ডিমান্ডিং সোর্স’, অর্থাৎ প্রথমেই সংবাদের সোর্স (উৎস) খোঁজা।
সাংবাদিকরা ডিমান্ডিং সোর্স নামে বর্তমানে যে কাজটি করছেন এবং সংবাদ মাধ্যমে যে কাজটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ, এ কাজটি সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী মুসলিম নাকীদগণ বহু আগেই করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম যখন কোনো হাদীস শুনতেন, সন্দেহ হলেই তারা সোর্স জিজ্ঞেস করতেন।
এ প্রসঙ্গে ইবনে সীরীন (৩২-১১০ হিজরী) রহ এর প্রসিদ্ধ বক্তব্য আছে যে, যখন বিভিন্ন ধরনের ফেতনা দেখা দেয়, তখন থেকে মুসলিমরা সতর্ক হয়ে যান। তিনি বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করতাম,
سموا لنا رجالكم
তোমার সোর্স (উৎস) কি? অর্থাৎ সোর্স বলা ছাড়া কোনো হাদীস গ্রহণ করা হবে না। (সহীহ মুসলিমের ভূমিকা, ১/১৫)
শোবা ইবনুল হাজ্জাজ রহ বলেন,
كل حديث ليس له حدثنا وأخبرنا فهو خل وبقل
যে হাদীসের হাদ্দাসানা ও আখবারানা নেই (অর্থাৎ সোর্স উল্লিখিত নেই) সেটা রাবীশের মত। (আল কিফায়াহ, ২৮৩ পৃষ্ঠা)
বোঝা গেল, মুসলিমরা একদম শুরু থেকেই র্সোস খুঁজেছেন। বর্তমান সিস্টেম তারা অনেক আগেই কেবল আবিষ্কারই করেননি, বরং বাস্তবে প্রয়োগও করে এসেছেন।
যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংবাদমাধ্যমে দ্বিতীয় যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাহলো, Investigating reliability অর্থাৎ উৎসটি নির্ভরযোগ্য কিনা তা যাচাই করা। মুসলিমরা এ কাজটিও অনেক আগেই করেছেন। রাসূলের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত হাদীসের সনদ (Chain of transmission) সঠিক কিনা, সেটাও তারা যাচাই-বাছাই করেছেন।
একজন সাংবাদিক তৃতীয় ধাপে যে কাজটি করেন তাহলো, উৎস যাচাই-বাছাইয়ের পরে তিনি দেখেন, একথার পক্ষে-বিপক্ষে আশেপাশের কোনো সমর্থন পাওয়া যায় কিনা। পরিভাষায় এটাকে বলা হয় Seeking Out Corroborating Evidence (সমর্থক দলিল খোঁজা)।
মুসলিম নাকীদগণও সনদের পক্ষে অন্য সনদ আছে কিনা, তা খুঁজে দেখেছেন। পারিভাষিকভাবে তারা এ বিষয়টিকে الاعتبار والمتابعة والشواهد ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দে ব্যক্ত করেন। উসূলে হাদীসের যে কোনো কিতাবে এ সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে।
এখানে সমর্থক দলিল খোঁজার প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের যমানার একটি উদাহরণ উপস্থাপন করছি।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. এর খেলাফতকালে এক বৃদ্ধা তার নাতীর সম্পদে মীরাস দাবি করেন। আবু বকর রাযি. তাকে বললেন, তোমার কোনো অংশ আছে এ মর্মে আল্লাহর কিতাবে কিছু নেই, আর রাসূলের সুন্নায় এমর্মে কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। অতএব এখন তুমি যাও, আমি অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখি তারা এ বিষয়ে কিছু জানে কিনা। তারপর তিনি সাহাবীদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন (যে তারা এ বিষয়ে কিছু জানে কিনা)। তখন হযরত মুগীরা বিন শোবা রাযি. বললেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি যে, তিনি দাদীকে নাতীর সম্পদ থেকে এক ষষ্ঠমাংশ দিয়েছেন। সিদ্দীকে আকবার রাযি. জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাথে এ বিষয়ে আর কেউ সাক্ষী আছে? তখন হযরত মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাযি. দাঁড়িয়ে তার মতই সাক্ষ্য দিলেন। অতপর হযরত আবু বকর রাযি. তাকে মীরাস থেকে সম্পত্তি প্রদান করলেন। (মুআত্তা মালিক ১০৭৫, মুসনাদে আহমাদ ১৭৯৮০, আবু দাউদ ২৮৯৪, তিরমিযী ২১০১,)
এ তিনটি পদ্ধতি যা কিনা রিপোর্টারগণ বর্তমানে প্রয়োগ করছেন, মুসলিম মনীষীগণ ১৪০০ বছর আগ থেকেই হাদীস সংরক্ষণে এর ব্যবহার করে আসছেন এবং প্রতি যুগেই তারা উপরোক্ত তিনটি মাধ্যমে হাদীসের প্রামাণ্যতা দেখিয়ে এসেছেন। এগুলো ছাড়াও তাদের নিকট আরো পদ্ধতি আছে। এর বিস্তারিত আলোচনা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে পশ্চিমা স্কলারদের হিস্টরিকল কৃটিকাল ম্যাথড সৃষ্টিই হয়েছে উনিশ শতকে। অথচ তাদের ইতিহাস হলো, প্রথম-দ্বিতীয় শতকের বা তারও আগের। আর এই ইতিহাস ইনভেস্টিগেট করার জন্য যে ম্যাথড, তা আবিষ্কার হয়েছে উনিশ শতকে। তার মানে উনিশ শতকের ম্যাথড দিয়ে অন্ধকার যুগের অনেক কিছু তারা বিচার করার চেষ্টা করেছেন।
হিস্টরিকল কৃটিকাল ম্যাথডের প্রাথমিক পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিয়েছেন জার্মান হিস্টরিয়ান রেনকা Leopold Von Ranke (1795-1886)। তার মৃত্যু ১৮৮৬ ঈসাব্দে। এরপর থেকে মূলত হিস্টরিকল কৃটিসিজম পূর্ণাঙ্গতা লাভ করতে থাকে। পরবর্তীতে হিস্টরিয়ান আরনস্ট Ernst Bernhaim (1850-1942) এর বই প্রকাশ হয় ১৮৮০ ঈসাব্দে। এসময় আরো দুজন প্রাচ্যবিদ যৌথভাবে কাজ করেছেন এবং রেঙ্কা সহ অন্যদের বই থেকে কৃটিসিজম ম্যাথড একত্র করে সংক্ষেপে উপস্থাপন করেছেন। তারা হলেন, C.V. Langlois (1863-1929) ও C. Seignobos (1854-1942) । তাদের রচিত বইটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ ঈসাব্দে। পরবর্তীতে Introduction To The Study Of History নামে এর ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। আব্দুর রহমান বাদাভী المدخل إلى الدراسات التاريخية নামে এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ প্রকাশ করেছেন।
তার মানে, হিস্টরিকাল কৃটিকাল ম্যাথডের আবিষ্কারই হয়েছে উনিশ শতকে। কিন্তু এর প্রয়োগ হয়েছে অনেক আগের ইতিহাসের উপর। যার ফলে খৃষ্টান জগত বিশাল গ্যাপের মাঝে পড়ে গিয়েছে। পক্ষান্তরে যখন থেকে হাদীস শুরু তখন থেকেই মুসলিমরা তাদের নাকদুল হাদীসের ম্যাথড প্রয়োগ করে এসেছেন।
১৮৮০ ঈসাব্দে যখন হিস্টরিয়ান আরনস বার্ন হায়েম এর বই প্রকাশিত হয়, ঠিক এর এক বছর আগে লেবাননে জন্ম গ্রহণ করেন আসাদ রুস্তুম, যিনি ছিলেন খৃস্টান জগতের এক বিখ্যাত হিস্টরিয়ান। তিনি শিকাগো থেকে গ্রাজুয়েশন করেন এবং হিস্টরিকাল কৃটিকাল ম্যাথড বিষয়ে অধ্যাপনা করতেন। একবার কোনো এককারণে আসাদ রুস্তুম দামেস্কের বিখ্যাত লাইব্রেরি ‘আল মাকতাবাতুয যাহিরিয়্যা’ পরিদর্শনে যান। সেখানে নাকদুল হাদীস সংক্রান্ত গ্রন্থাবলী দেখে অবাক হয়ে পড়েন যে, যেসকল ম্যাথড নিয়ে আমরা কাজ করি এবং সেগুলোও প্রাথমিক পর্যায়ের, মুসলিমরা এত আগে এত সুনিপুণভাবে সেসব বিষয়ে কাজ করেছেন। বলাবাহুল্য, আসাদ রুস্তুম হিস্টরিকাল কৃটিকাল ম্যাথড সম্পর্কে তার পূর্বসূরীদের কাজ সম্পর্কে ভালভাবে অবগত ছিলেন। তিনি আন্দালুসের বিখ্যাত মুসলিম মনীষী কাজী ইয়ায রহ. এর নাকদুল হাদীস সংক্রান্ত বিখ্যাত কিতাব আল ইলমা الإلماع দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। ভেবে অবাক হয়ে যান যে, হিস্টরিকাল কৃটিসিজাম এর উপর এত সুন্দর বই হতে পারে। এসব কিছু দেখে তার ভেতরে এ বিষয়ে আরবীতে গ্রন্থ রচনার প্রেরণা জাগে এবং তিনি `মুসতালাহুত তারীখ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এ বইয়ের বড় অংশ জুড়ে মুসলিমদের নাকদুল হাদীস সংক্রান্ত কিতাবাদির উদ্ধৃতিতে আলোচনা করেছেন।
আসাদ রুস্তুম তার গ্রন্থের শুরুতে বলেন, হিস্টরিকাল কৃটিকাল ম্যাথড সম্পর্কে সর্বপ্রথম সুবিন্যস্তভাবে ও পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ করেছেন মুসলিম হাদীস বিশারদগণ। তার গ্রন্থে তিনি বিভিন্নভাবে একথাটি ব্যক্ত করেছেন যে,
যদি ওয়েস্টার্ন স্কলাররা জানত যে, মুসলিমদের কাছে এ ধরনের ম্যাথড আছে, তাহলে হিস্টরিকাল কৃটিকাল ম্যাথড আবিষ্কারের জন্য তারা উনিশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করত না। বরং অনেক আগেই মুসলিমদের দেখে তারা এ বিষয়টি আবিষ্কার করে ফেলত। তিনি আরো বলেন,
খৃস্টান স্কলাররা বর্তমানে যেসব ম্যাথড নিয়ে গর্ব করছে, বাস্তবতা হলো, মুসলিমগণ হাজার বছর পূর্বে তা লিপিবদ্ধ করেছেন এবং বাস্তবে প্রয়োগ করে গেছেন। আর বহু দিক থেকে মুসলিমদের ম্যাথড অনেক বেশি শক্তিশালী।
আসাদ রুস্তুম মুসলিম নন, বরং তিনি একজন খৃস্টান ঐতিহাসিক। তার বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হলো যে, মুসলিমগণ রাসূলের হাদীস সংরক্ষণে যা যা করা দরকার ছিল, তার সবই করেছেন এবং এক্ষেত্রে তাদের কাজগুলো একদিকে যেমন অনেক মজবুত, অপরদিকে যুক্তিসঙ্গতও।
এছাড়াও প্রাচ্যবিদ Harald Motzki সহ আরও অনেকে মুসলিমদের নাকদুল হাদীস গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে,
The classical Islamic method of filtering out forged hadiths was much more effective than earlier scholars like Goldziher and Juynboll have believed. (Haduth Muhammad’s Legacy, By Jonathan A.G. Brown, page 280)
অর্থাৎ গোল্ড যিহার, জায়ম্বল সহ অন্যান্য প্রাচ্যবিদরা ভেবেছিলো যে, ইসলামিক ক্লাসিকাল ম্যাথডটি (নাকদুল হাদীস) একটি দুর্বল ম্যাথড, কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটি তাদের ধারণার চেয়েও বহু গুণে শক্তিশালী। (Haduth Muhammad’s Legacy, By Jonathan A.G. Brown, page 280)
শেষ কথা হলো, যেহেতু মুসলিম নাকীদগণ যখন থেকে হাদীস তখন থেকেই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে প্রত্যেক যুগে হাদীস কৃটিসাইজ (যাচাই-বাছাই) করে আসছেন, এবং এক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতি অত্যন্ত যৌক্তিক ও শক্তিশালী, সুতরাং এরপরও যদি কেউ কোনো হাদীস অস্বীকার করে তাহলে তারই দায়িত্ব একথা প্রমাণ করা যে, সে কেন অস্বীকার করছে, এবং এক্ষেত্রে তার কাছে কোনো দলিল আছে কিনা? তা না করে ঢালাওভাবে হাদীস অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
উপরোক্ত বাস্তবতা উপলব্ধি করেই প্রাচ্যবিদ ডেভিড পাওয়ার বলেছেন,
The burden of proof lies on those who deny the authencity of reports attributed to the prophet. (On Bequests In Early Islam, page 199-200)
প্রাচ্যবিদদের ঢালাওভাবে হাদীসকে অস্বীকার করা ঠিক না। তারা যদি কোনো হাদীসে সমস্যা খুঁজে পায়, তাহলে তাদের দায়িত্ব সেটা প্রমাণ করে দেখিয়ে দেওয়া।
শায়খ আব্দুল্লাহ নাজীব হাফিযাহুল্লাহ
উসতায, উলূমুল হাদীস বিভাগ, দারুল উলূম হাটহাজারী
(মু্আসসাসা ইলমিয়্যাহ কর্তৃক আয়োজিত হাদীস শাস্ত্র পরিচিতি-২ কোর্সে ‘প্রাচ্যবিদ গোষ্ঠী ও ইনকারে হাদীস’ শিরোনামে শায়খ আব্দুল্লাহ নাজীব হাফিযাহুল্লাহ ২টি মূল্যবান দারস প্রদান করেন। বক্ষমান লেখাটি মূলত শায়খের উক্ত দারসদ্বয়ের অল্প কিছু অংশের লিখিতরূপ।)